কক্সবাজারের উখিয়ায় ১৬০ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চলে উন্মুক্ত কারাগার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে কারা অধিদপ্তর। এতে আপত্তি জানিয়ে ও ভূমির বন্দোবস্ত বাতিল চেয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বন বিভাগ।
কারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দাবি, জায়গাটা বন বিভাগের নয়। বরং ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত। আর বন বিভাগ বলছে, জায়গাটি বন বিভাগের মালিকানাধীন এবং গেজেটভুক্ত বনাঞ্চল। এখনো সেখানে হাজার হাজার গাছপালা এবং পশুপাখির বিচরণ রয়েছে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সরওয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জায়গাটি বন বিভাগের। বনভূমি বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। জানার পর জমির বরাদ্দ বাতিলের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত ওই জায়গায় কোনো স্থাপনা না করতে কারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছি।’
বন বিভাগ ও কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, উন্নত বিশ্বের আদলে ‘উন্মুক্ত কারাগার’ নির্মাণের জন্য উখিয়ার পাগলিরবিল বনাঞ্চলে ১৬০ একর ভূমি কারা অধিদপ্তরের নামে বরাদ্দ দিয়ে ২০১৯ সালে ইজারা দলিল সম্পাদন করে দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। গত ২৭ মে উখিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জায়গাটি কারাগার কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেন। এরপর সীমানা নির্ধারণ করে খুঁটি বসানো হয়।
২৫ জুন বন বিভাগের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে খুঁটিগুলো উপড়ে ফেলে জায়গাটি দখলে নেন। ৩০ আগস্ট উন্মুক্ত কারাগারের নামে বরাদ্দ দেওয়া ১৬০ একর বনভূমির বন্দোবস্ত বাতিলসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় বন অধিদপ্তর।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মিত টহলের সময় পাগলিরবিল বনাঞ্চলে কয়েকটি খুঁটি দেখতে পেয়ে বনকর্মীরা তাঁকে বিষয়টি জানান। পরে তিনিসহ বনকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে খুঁটিগুলো সরিয়ে ফেলে বনাঞ্চল দখলমুক্ত করেন। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জায়গায় সরকারি স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে বন বিভাগকে জানানো হয়নি।
সরকারের উন্নয়ন কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে এবং তাঁরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান কক্সবাজার জেলা কারাগারের জেল সুপার মো. শাহ আলম খান।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে উখিয়ায় ১৬০ একর ভূমি কারা অধিদপ্তরের নামে বন্দোবস্ত দিয়ে নামজারি হয়ে খাজনাও পরিশোধ করা হচ্ছে। জায়গাটা ১ নম্বর খাস খাতিয়ানভুক্ত জমি। ১৬০ একর জায়গায় খুঁটি দিয়ে কাঁটাতারের সীমানা বেড়া নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে বন বিভাগের বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই।’
তবে স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরাও চান না সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছপালা ও হাতির অভয়ারণ্য ধ্বংস করে উন্মুক্ত কারাগার নির্মাণ হোক। এমনিতে উখিয়ার প্রায় সাত হাজার একরের বনাঞ্চল উজাড় ও কয়েকটি পাহাড় নিধন করে সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়শিবির গড়ে তোলা হয়েছে। যে কারণে ৬০টির বেশি এশিয়ান প্রজাতির বন্য হাতির জীবন ঝুঁকিতে পড়েছে।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, ওই বনাঞ্চলে কোনো স্থাপনা তৈরি হলে বৈলাম, গর্জন, জাম, তেলসুর, চাপালিশ, আকাশমণি, গামারি, আছারগোল, ডুমুর, বটসহ বিভিন্ন প্রজাতির হাজারো গাছ কাটা পড়বে। কাটতে হবে উঁচু পাহাড়ও। এ ছাড়া অজগর, হরিণ, বানর, শিয়াল, সাপ, শজারু, শূকরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণী ও পাখির আবাসস্থল ধ্বংস হবে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উন্মুক্ত কারাগারের জন্য নির্ধারিত উখিয়ার পাগলিরবিল এলাকায় পাঁচ-ছয়টি পাহাড়, তিনটি প্রাকৃতিক ছড়া ও কয়েক হাজার গাছবেষ্টিত বনাঞ্চল রয়েছে। ৪০ থেকে ৪৫টি বসতিও রয়েছে সেখানে।
বনভূমিতে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে পরিবেশের ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় রাখা উচিত বলে মনে করেন পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এনভায়রনমেন্ট পিপল’–এর প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উখিয়া-টেকনাফে এমনিতেই কয়েক হাজার একর বনাঞ্চল রোহিঙ্গাদের কারণে ধ্বংস করা হয়েছে। এখন উন্মুক্ত কারাগারের জন্য ১৬০ একর বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হলে আশপাশের বনাঞ্চলও উজাড় হবে। এতে করে বনভূমি জবরদখল, হাতির বিচরণক্ষেত্র ও বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ ওই এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। সুত্র : প্রথম আলো
পাঠকের মতামত